কথাগুলো বোধহয় একটু বেশিই রোমান্টিক হয়ে গেল, তাই না? আপনাদের মধ্যে যারা নিয়মিত মেট্রোতে যাতায়াত করেন, তারা অবশ্যই জানেন মেট্রোর ভিড় কাকে বলে। ঠেলাঠেলি, মারামারি, গোলমাল, এই সব কিছু নিয়েই হয়ত আপনাদের মেট্রোতে চড়ার অভিজ্ঞতা। প্রতিদিনের জীবনের ব্যস্ততার কথাই হয়ত মনে করিয়ে দেয় কলকাতা মেট্রো আমনাদের। আমি কোনো দোষ দিতে পারিনা আপনাদের। তবে এই মেট্রোকে নিয়ে আমার যে Fascination, আসুন তার সঙ্গে আপনাদের একটু পরিচয় করিয়ে দিই।
১৯৪৯ সাল
ভারত তখন সবেমাত্র স্বাধীন হয়েছে। যা আগে ছিল পূর্ব বাংলা (এবং পরে যা হবে বাংলাদেশ), সেই পূর্ব পাকিস্তান থেকে তখন হাজারে হাজারে, কাতারে কাতারে মানুষ ছুটে আসছে ভারতে, বিশেষ করে নিরপরাধ হিন্দুরা, যাদের ধর্মের জন্য দেশ ছাড়তে হয়েছে চোখের জলের মধ্যে দিয়ে। আর যে মহান শহর কলকাতা ছিল পরাধীন ভারতের গৌরব, তার উপর বেড়ে চলেছে জনসংখ্যার চাপ। যে শহর ভারতবর্ষকে স্বাধীন করলো, যে শহর আমাদের দিল জন গণ মন, বন্দে মাতরম, সেই শহরে তখন ভিড়ের চাপ, বিশৃঙ্খলা বেড়ে চলেছে।
তখনি তত্কালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় বুঝে গিয়েছিলেন,যে এই ভাবে চলতে থাকলে কলকাতার উন্নতি করা তো দুরের কথা, কলকাতায় বাস করাটাই মানুষের পক্ষে কঠিন হয়ে পরবে। তাই কলকাতা শহরের প্রয়োজন আধুনিক পরিবহন ব্যবস্থা, সময়ের সাথে সাথে যার সম্প্রসারণ ও ক্রমাগত উন্নতিসাধন বাড়তে থাকা লোকসংখ্যার চাপকে নিয়ন্ত্রনের মধ্যে রাখবে। কিন্তু তত্কালীন সরকার, বিশেষ করে কেন্দ্রীয় সরকার, এই প্রজেক্টকে কোনো রকম গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি, অন্তত আমরা যেটুকু জানি তা থেকে এটা স্পষ্ট। অবশ্য তার জন্যে বোধ হয় সরকারকে দোষ দেওয়া যায়না, কারণ সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশে তখন হাজার সমস্যা।
১৯৭২ সাল
শহীদ ক্ষুদিরাম স্টেসন, বাইরে থেকে |
৭০ এর দশকে কলকাতার রাস্তা যে নরক হয়ে গিয়েছিল,তা বোধহয় আর বলে দেওয়ার প্রয়োজন থাকে না. আমার মায়ের এক পিসি তখন কলকাতায় থাকতেন। যদিও তিনি কলকাতা খুব ভালো করেই চিনতেন, কিন্তু রাস্তা কোথাও ভেঙ্গে দেওয়ার কারণে, কোথাও বা ঘুরিয়ে দেওয়ার কারণে তিনিও রাস্তা ঠিক মত চিনে সহজে বাড়ি আসতে পারতেন না অনেক দিন।
১৯৮৪ সাল
১২ বছর কষ্টের পরে অবশেষে কলকাতার মানুষ পেল এমন একটি পরিবহন ব্যবস্থা, যা দেখে সুধু ভারতের লোকজনই নয়, আসেপাসের সমস্ত দেশের লোকেরাও অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। যদিও কলকাতা তখনও খুবই ঘিঞ্জি ছিল, কিন্তু মাটির নিচের মেট্রো ব্যবস্থা যেন জাদুকাঠির ছোয়ায় বদলে দিয়েছিল সবকিছুকে। প্রথম ট্রেন চলল Esplanade থেকে ভবানীপুর, এমং কিছু দিনের মধ্যেই তা সম্প্রসারিত হলো শ্যামবাজার পর্যন্ত।
BBC এর একটি সমীক্ষাতে তখন বলা হয়েছিল যে কলকাতা মেট্রো হলো বিশ্বের সবথেকে উন্নত পাতাল রেল ব্যবস্থা। আজ এটা হয়ত বিশ্বাস করতেই কষ্ট হয়। সাংহাই কিম্বা লন্ডন টিউবের কথা বাদ দিন, ঘরের কাছের দিল্লি মেট্রোর তুলনায় কলকাতা মেট্রো আজ নিস্প্রভ।
যাই হোক, আরো ১০ বছর কেটে গেল, তকন দমদম এবং বেলগাছিয়া সংযোজিত হলো মেট্রোর সঙ্গে। যদিও আগেই দমদম ও বেলগাছিয়ার কাজ হয়ে গিয়ে ছিল, কিন্তু তা মূল লাইনের সঙ্গে জোরে দেওয়া হইনি, এবং সুধু মাত্র বেলগাছিয়া থেকে দমদম, এই ২.১৫ কিমি রাস্তাতেই রেল চলত। কিন্তু ১৯৯৪ সালে এই বিচ্ছিন্ন লাইনটি যোগ দিল মূল মেট্রো প্রকল্পের সঙ্গে, যখন বেলগাছিয়া আর শ্যামবাজারের মধ্যে প্রথম ট্রেন চলল।
একটি বিষয় মনে রাখার মত। সবাই বলেন, যে নতুন মেট্রো ব্যবস্থা কলকাতা শহরের বাসিন্দাদেরও মনে পরিবর্তন আনে। যেখানে মাটির উপরে সেই যানজট, বিশৃঙ্খলা, ভিড় যেমন থাকার তেমনি ছিল, মাটির নিচে নামলেই যেন প্রবেশ করা যেত এক অন্য জগতে। লোকেরা সুবিন্যস্তভাবে যাতায়াত করছে, নির্ধিস্ত সময়ে ট্রেন থেকে নামছে, কোনো রকম আবর্জনা কথাও ফেলা হচ্ছে না, এই সবের জন্য অনেকেই বলেন যে মেট্রো ব্যবস্থা যেন এক টুকরো ইউরোপকে এনে বসিয়ে দিয়েছে এশিয়ার বুকে।
আরো ছোটখাটো অনেক সমস্যা মিটিয়ে শেষ পর্যন্ত দমদম থেকে টালিগঞ্জ পর্যন্ত মেট্রো ব্যবস্থা বাড়িয়ে দেওয়া হলো, সেপ্টেম্বর ২৭ (১৯৯৫) থেকে।
এখানেই কাজ থেমে থাকেনি। টালিগঞ্জের দক্ষিনে আরো সম্প্রসারণের কাজ চলতে থাকে। প্রথমে টালিগঞ্জ (মহানায়ক উত্তম কুমার) স্টেসন থেকে কবি নজরুল (গড়িয়া বাজার) পর্যন্ত, ২০০৯ সালে। এবং তার পরে কবি নজরুল থেকে কবি সুভাষ (নিউ গড়িয়া) পর্যন্ত, ২০১০ সালে।
একই সঙ্গে উত্তরে দমদম থেকে নোয়াপাড়া পর্যন্ত মেট্রো লাইন বাড়িয়ে দেওয়া হলো ২০১৩ সালে। এই নোয়াপাড়া স্টেসন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এখানেই ভবিষ্যতে মেট্রোর প্রথম লাইনের সঙ্গে চতুর্থ লাইনের যোগাযোগ ঘটবে, যা বারাসাতকে যোগ করবে মূল কলকাতার সঙ্গে। নোয়াপাড়া স্টেসন হলো কলকাতা মেট্রোর সবথেকে বড় ও অত্যাধুনিক স্টেসন, যদিও এখনো পর্যন্ত এখানে সব ট্রেন ঢোকে না।
কলকাতা মেট্রোর ভবিষ্যত
মেট্রোর উত্তরে সম্প্রসারণের কাজ এখনো চলছে। অন্য পাঁচটি লাইন তো বটেই, এমনকি আমাদের সাধের উত্তর-দক্ষিন মেট্রোও আরো বাড়বে। এর পরে নোয়াপাড়া থেকে বরানগর পর্যন্ত সম্প্রসারণ হবে, যেখান থেকে আবার দক্ষিনেশ্বর পর্যন্ত আবার সম্প্রসারণ হবে। বরানগর স্টেসনে কলকাতা মেট্রোর পঞ্চম লাইন (বারাকপুর লাইন) যুক্ত হবে উত্তর-দক্ষিন মেট্রোর সঙ্গে।
কলকাতা মেট্রো, সম্পূর্ণ প্রকল্প (ফেজ ১) |
অন্যদিকে পূর্ব-পশ্চিম মেট্রো (East-West Corridore) যুক্ত করবে সল্ট লেক সেক্টর ৫ কে, পশ্চিমে হাওড়া ময়দানের সঙ্গে, যা হবে এশিয়া মহাদেশের প্রথম নদীর নিচে দিয়ে যাওয়া মেট্রো লাইন। কাজ এখন দ্রুত গতিতে এগোচ্ছে। কিন্তু তা সত্তেও রাজনৈতিক কারণে তা নানা জায়গায় বাধা পাচ্ছে। যদিও কয়েকদিন আগের হাইকোর্টের অর্ডার অনুসারে কাজ সম্পূর্ণ করতে কোনো বাধা নেই।
এখনকার প্ল্যান অনুসারে মূল মেট্রোর সঙ্গে East-West Corridore যুক্ত হবে সেন্ট্রাল স্টেসনে, যেখান থেকে আমরা গাড়ি চেঞ্জ করতে পারব। অন্যদিকে মেট্রোর তৃতীয় লাইনের কাজ চলছে একই সঙ্গে, যা Esplanade কে দুক্ত করবে কলকাতার দক্ষিনে অবস্থিত জোকার সঙ্গে।
সবশেষে থাকছে ষষ্ঠ লাইনের প্ল্যান, যা নিউ গড়িয়া অর্থাত কবি সুভাষকে কলকাতা আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের সঙ্গে যুক্ত করবে, নতুন জয় হিন্দ থেসনের মাধ্যমে। এটিই হবে কলকাতা মেট্রোর সবথেকে বড় লাইন, প্রায় ৩২ কিলিমিটার দৈর্ঘের।
শেষ কথা
কলকাতা মেট্রো প্রকল্পগুলি সম্পূর্ণ হয়ে যাওয়ার পর মানুষের পক্ষে এখানে থাকা অনেক সুবিধার ও আরামের হয়ে যাবে। এবং খুব তাড়াতাড়িই বাকি কাজ সম্পূর্ণ করা সম্ভব, কিন্তু রাজ্য সরকারের রাজনীতির ও কেন্দ্রীয় সরকারের ঔদাসীন্যের ফলে সময়টা বেড়ে চলেছে। তাই আমাদের উচিত বিশেষ করে রাজ্য সরকারকে চাপ দেওয়া এই সমস্ত কাজ কমপ্লিট করার জন্য।
২০১১ থেকে ক্ষমতায় আসার পর থেকে প্রায় কিছুই করেনি আমাদের নতুন রাজ্য সরকার, যদি সত্যি বলতে হয়। আসা করা যায় যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদী আসার পর থেকে যে কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে দেশে, তার কল্যানে অন্তত কিছুটা তাড়াতাড়ি এই কাজটিও সম্পূর্ণ হবে।
কলকাতা মেট্রো আমার কাছে কোনো সাধারণ কিছু নয়, তা হচ্ছে একটি স্বপ্ন যা আমরা সত্যি হতে দেখেছি। তা হচ্ছে মহানগরী কলকাতার সাফল্যের কাহিনী, প্রতিদিন চলতে থাকা প্রতিটি কলকাতাবাসীর সংগ্রামের, ত্যাগের, সহিষ্ণুতার গল্প। তাই আসুন, যাত্রী হিসেবে আমরা যতটা সম্ভব সুশৃঙ্খল, সন্দর ও পরিচ্ছন্ন রাখি আমাদের সাধের মেট্রোকে।